SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

চতুর্থ শ্রেণি (প্রাথমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

ত্রয়োদশ অধ্যায়

ধন্য পোপ দ্বিতীয় জন পল

পোপ দ্বিতীয় জন পল ছিলেন কাথলিক মণ্ডলীর একজন ধর্মগুরু। তিনি গোটা বিশ্বমানবজাতির কাছে

ই ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাতা, পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনকারী, নিরাময়কারী এবং বর্তমান বিশ্বের একজন প্রবক্তা। তিনি প্রায় সাতাশ বছর পর্যন্ত পোপ হিসেবে ঈশ্বর ও মানুষের সেবা করে গেছেন। বিশ্বব্যাপী সব ধরনের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ও প্রশংসনীয়। এমনই এক আদর্শ ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদেরও জানা দরকার।

জন্ম ও শৈশব

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মে পোপ দ্বিতীয় জন পল পোলান্ডের ক্রাকৌ-এর ভাইশিন্‌জকি নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পোপ হওয়ার আগে তাঁর নাম ছিল ক্যারল যোসেফ ভয়তিয়া। ছোট্টবেলায় বন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন ‘ললেক' নামে। তাঁর বাবার নাম ছিল ক্যারল ভয়তিয়া (সিনিয়র) এবং মায়ের নাম ছিল এমিলিয়া ভয়তিয়া। বাবা ছিলেন সেনা কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে যোসেফের মা মারা যান। এরপর তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের আদর-যত্নে বড় হতে থাকেন। কিন্তু বড় ভাই মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। 

যোসেফ একজন নামকরা স্পোর্টসম্যান ছিলেন। ফুটবল, বরফের উপরে স্কিইং ও পাহাড়ে আরোহণ ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ফুটবল খেলায় গোলরক্ষক হিসেবে তিনি ভালো ছিলেন । পোপ হওয়ার পরও তিনি ১৫ বছর পর্যন্ত প্রতি বছর ছুটি নিয়ে পর্বতে আরোহণ করতে যেতেন।

পড়াশোনা

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে যোসেফ তাঁর এলাকা থেকে হাই স্কুল পড়া শেষ করেন। এরপর তিনি ক্রাকৌ-এর জাগিলোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই সময় পৃথিবীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। এই পরিস্থিতিতে যোসেফ ‘ডেভিড’ ও ‘যোব’ নামে দুইটি নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করেন।

এগুলোর পাশাপাশি তিনি একজন শ্রমজীবী হিসেবে চুনাপাথর কাটার কারখানায় কাজ করতে থাকেন। এভাবে তিনি নাৎসী বাহিনীর আক্রমণ থেকে রেহাই পান। একুশ বছর বয়সে, ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে যোসেফের বাবা মারা যান। এ সময় যোসেফ সমগ্র পোলান্ডে একজন নামকরা অভিনেতা হিসেবে পরিচিত হন।

পুরোহিত পদে যোসেফ

তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যোসেফ এসময় পুরোহিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘গোপন সেমিনারিতে' যোগ দেন। পাশাপাশি সাবান তৈরির কারখানার শ্রমিকের কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে একবার এক মিলিটারি ট্রাক তাঁকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে তিনি পড়ে গিয়ে কাঁধে মারাত্মক আঘাত পান। অনেক যুবককে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে বন্দী করে। কিন্তু একজন কার্ডিনাল যোসেফ ও আরও কয়েকজন সেমিনারিয়ানকে আর্চবিশপ হাউজে লুকিয়ে রাখেন। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি আবার পড়াশুনা আরম্ভ করেন। এরপর তিনি যাজকপদে অভিষিক্ত হন। তিনি রোমে যান ও পড়াশুনা শেষে দর্শন শাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফেরেন। নিজ দেশে ফিরে তিনি ঐশতত্বের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে যোসেফ ক্লাকৌ শহরের একটি ধর্মপল্লীতে কাজ করতে শুরু করেন। এখানে তিনি যুবক-যুবতীদের জন্য প্রচুর সময় দিতে থাকেন। একই সময়ে তিনি জাগিলোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিবিদ্যা শিক্ষা দিতে শুরু করেন ।

বিশপ, আর্চবিশপ ও কার্ডিনাল হিসেবে জন পল

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে যোসেফ ক্রাকৌ ধর্মপ্রদেশের সহকারী বিশপ পদে অভিষিক্ত হন। এর পাঁচ বছর পর তিনি আর্চবিশপ মনোনীত হন। এরও ছয় বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কার্ডিনাল পদ লাভ করেন।

পোপ হিসেবে জন পল

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে তিনি পোপ পদে নির্বাচিত হন। পোপ পদে নির্বাচিত হয়ে রোমের সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে প্রথম খ্রিষ্টযাগের উপদেশে তিনি বিশ্বমণ্ডলীকে বলেন, ‘ভয় পেয়ো না।' এটাই ছিল তাঁর জীবনের এক নম্বর মূলমন্ত্র।

মানুষকে একত্রিতকরণ

পোপ দ্বিতীয় জন পলের দ্বিতীয় মূলমন্ত্রটি ছিল “যুদ্ধ নয়, শান্তি”। বিশ্বব্যাপী সকলেই শান্তি চায়, ন্যায্যতা ছাড়া শান্তি আসে না। আর ন্যায্যতার অর্থই হলো যার যা পাওনা তাকে তা দেওয়া। এ জন্য পোপ দ্বিতীয় জন পল সবার মানবাধিকার রক্ষার প্রতি খুব যত্নবান হন। তিনি নৈতিকতার পক্ষ সমর্থন করেন। সর্বদা তিনি দরিদ্র, নিপীড়িত ও নির্যাতিতদের পক্ষ গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালে যুদ্ধে জড়িত দেশগুলোকে তীব্র নিন্দা করেন ও শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানান। বিশেষত ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক ও কুয়েত যুদ্ধ এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সময় তিনি তীব্র নিন্দা জানান ৷

ক্ষমার উজ্জ্বল আদর্শ

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে পোপ দ্বিতীয় জন পল লোকদের সাথে দেখা করছিলেন। আর সেই সময় হঠাৎ মুহম্মদ আলী আজ্জা নামে এক তুর্কি নাগরিক পোপকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে পোপ মহোদয়কে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অন্যদিকে সন্ত্রাসী আলী আজ্জাকেও পুলিশেরা ধরে কারাগারে নিয়ে যায়। পোপকে ছয় ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয় মোট ২২ দিন। এরপর তিনি ঘরে গিয়ে আলী আজ্জার মন পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। দুই সপ্তাহ পরে তিনি আবার হাসপাতালে যান দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের জন্য। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পোপ মহোদয় কারাগারে বন্দী আলী আজ্জাকে দেখতে যান এবং তাকে ক্ষমা করেন ও তার জন্য প্রার্থনা করেন। তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান মুহম্মদ আলী আজ্জাকে যেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হয়। তাঁর এই অতি মহান ক্ষমার আদর্শ দেখে বিশ্ববাসী সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

সকলকে সমান চোখে দেখা

পোপ দ্বিতীয় জন পল ছোট-বড়, ধনী-গরিব,নারী-পুরুষ, খ্রিষ্টান অখ্রিষ্টান সবাইকে সমান চোখে দেখতেন । তিনি পোপ হিসেবে ১০৪ বার বিদেশযাত্রা করে ১৪২টিরও বেশি দেশে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। অতীতের সকল পোপদের চাইতে পোপ দ্বিতীয় জন পলই বেশিসংখ্যক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। আবার তিনিই বিশ্বে যুবদিবস পালন করার রীতি গড়ে তুলেছেন। তিনি যুবক-যুবতীদের এতই ভালোবাসতেন যে, তাঁকে যুবক-যুবতীদের পোপ বলে অনেকে সম্বোধন করতেন।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৯শে নভেম্বর তৎকালীন সরকারের আমন্ত্রণে পোপ দ্বিতীয় জন পল বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত সফরে আসেন। সেদিন তিনি ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পঞ্চাশ হাজার খ্রিষ্টভক্তের জন্য খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করেন। ঐ খ্রিষ্টযাগে তিনি ১৭ জন বাংলাদেশি যুবককে যাজক পদে অভিষিক্ত করেছিলেন ।

জন পলের ধন্য শ্রেণিভুক্তকরণ

সিস্টার মারী সাইমন পীয়ের নামক ফরাসি দেশের একজন সিস্টার পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পোপ জন পলের মধ্যস্থতায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এই সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পোপ দ্বিতীয় জন পল একজন পবিত্র ও সাধু ব্যক্তি। একদিন তিনি সাধু শ্রেণিভুক্ত হবেন। এই লক্ষ্যে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে তারিখে পোপ ২য় জন পলকে ধন্য শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এই মহান পোপকে আমরা এখন বলি ধন্য পোপ দ্বিতীয় জন পল।

৩। সঠিক উত্তরটিতে টিক (√)   চিহ্ন দাও 

৩.১ যোসেফ কোন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন?

(ক) কয়লার

(খ) সাবানের

(গ) লোহার

(ঘ) ইস্পাতের

৩.২ কত খ্রিষ্টাব্দে মিলিটারি ট্রাক যোসেফকে ধাক্কা দেয়?

(ক) ১৯৪৪

(খ) ১৯৪৫

(গ) ১৯৪৬ 

(ঘ) ১৯৪৭

৩.৩ যাজক পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর যোসেফ কোথায় যান ?

(ক) জার্মান

(খ) রোম

(গ) পোলান্ড

(ঘ) ফ্রান্স

৩.৪ পোপ দ্বিতীয় জন পল কোন বিষয়ে রোম থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন? 

(ক) মণ্ডলীর আইন 

(খ) দর্শন

(গ) বাইবেল

(ঘ) ঐশতত্ত্ব

৩.৫ পোপ দ্বিতীয় জন পল কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিশিক্ষা দিতেন ?

(ক) উর্বানা

(খ) পন্টিফিক্যাল

(গ) জাগিলোনিয়ান 

(ঘ) নটর ডেম

৪। সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও 

(ক) পোপ দ্বিতীয় জন পলের দ্বিতীয় মূলমন্ত্রটি কী ছিল?

(খ) যোসেফ কত খ্রিষ্টাব্দে ক্রাকৌ শহরের একটি ধর্মপল্লীতে কাজ করেন? (গ) পোপ দ্বিতীয় জন পল কোথা থেকে দর্শন শাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন?

৫। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

(ক) কোন ঘটনার মাধ্যমে এবং কীভাবে তিনি ক্ষমার উজ্জ্বল আদর্শ হতে পেরেছেন? 

(খ) বাংলাদেশে পোপ দ্বিতীয় জন পলের আগমন বিষয়ে ব্যাখ্যা কর।

Content added || updated By